রুদ্র মোহাম্মদ ইদ্রিস॥
মানুষের জীবনকাল সীমিত, অথচ তার স্বপ্ন অসীম। এ যেনো এক চিরন্তন দ্বন্দ্ব-মৃত্যুর জানালা খুলে দেয় জীবনের সীমা, আর মনের কপাট খুলে দেয় অগণন সম্ভাবনার দ্বার। এই দ্বন্দ্ব থেকেই জন্ম নেয় সভ্যতা, প্রযুক্তি, স্থাপত্য, শিল্প-এবং পাশাপাশি জন্ম নেয় এক অদৃশ্য অন্ধকার, যার নাম লোভ, অনৈতিকতা এবং বৈষম্য।
“মানুষ স্বল্পায়ু-অথচ নির্মাণ দীর্ঘ”-এই কথাটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, আমরা যারা এই পৃথিবীতে ক্ষণিকের অতিথি, তারা এমন সব স্থায়ী কিছু নির্মাণের চেষ্টা করি যা আমাদের আয়ুর সীমাকে অতিক্রম করে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই নির্মাণ কি কেবল পাথরের দালান আর প্রযুক্তির অগ্রগতি? নাকি এর ভেতরে আছে লোভের, বৈষম্যের এবং দুর্নীতির মিশ্র ধারা?
আজকের পৃথিবীতে এক ভয়াবহ বৈপরীত্য আমাদের চোখে পড়ে- ” কিছু মানুষ খাবার জমায়, কিছু মানুষের খাবারের সন্ধানে দৌড়ায়! মানুষের চাহিদা দিনে দিনে সীমাহীন রূপ নিচ্ছে। ‘চাই চাই আরও চাই’-এই মনোভাব আমাদের সমাজকে করে তুলছে আত্মকেন্দ্রিক, বিবেকহীন। খাদ্য, সম্পদ, শিক্ষা, এমনকি সুযোগ-সবই সীমিত, কিন্তু বিতরণে নেই ন্যায়। একপক্ষ মজুদ করে, অন্যপক্ষ উপবাসে দিন কাটায়।
এই অসাম্য আর অদৃশ্য দুর্ভোগের চূড়ান্ত রূপ ধরা পড়ে ঘুষের হারে। পত্রিকার শিরোনাম, “বাড়লো ঘুষের রেট”-এ যেনো একটা ব্যঙ্গাত্মক অথচ নির্মম বাস্তবতা। ঘুষ এখন যেন নিয়মের অংশ, পদ্ধতির ভিত, উন্নয়নপ্রক্রিয়ার মূল চালিকাশক্তি। মানুষ যেন স্বপ্ন দেখছে, কিন্তু সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে পথ খুঁজছে ঘুষের রাস্তায়। সরকারি চাকরি হোক কিংবা ব্যবসায়িক অনুমোদন-ঘুষ এখন ‘অফার’ নয়, ‘শর্ত’।
এই পরিস্থিতিতে সমাজ কীভাবে টিকে থাকবে? আমরা যে পৃথিবী ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য রেখে যাচ্ছি, তা কি কেবল পুঁজি আর লোভে গড়া এক নিষ্ঠুর, নিষ্প্রাণ সমাজ হবে?
আমরা ভুলে যাচ্ছি-একটি সভ্যতা টিকে থাকে কেবল তার প্রযুক্তি বা অবকাঠামো দিয়ে নয়, বরং তার নৈতিকতা, মানবিকতা এবং সাম্যবোধ দিয়ে। সুতরাং, আমাদের উচিত স্বপ্নের সঙ্গে বিবেকের সমন্বয় ঘটানো। স্বপ্ন দেখা প্রয়োজন, কিন্তু তা যেন হয় অন্যের অধিকার হরণ করে নয়। খাবার জমানো নয়, ভাগাভাগির সংস্কৃতি গড়ে তোলা হোক। দুর্নীতি নয়, ন্যায়ের রীতিই হোক উন্নয়নের ভিত্তি।
স্বপ্নের অসীমতা ও জীবনের সসীমতা আমাদের শেখায়-সময় সীমিত, কিন্তু প্রভাব হতে পারে চিরস্থায়ী। এই সংক্ষিপ্ত সময়টুকুকে যদি আমরা অন্যের কল্যাণে কাজে লাগাতে পারি, তবেই সত্যিকার অর্থে মানবজাতির নির্মাণ হয়ে উঠবে মর্যাদাপূর্ণ ও স্থায়ী। নয়তো আমাদের লোভ আর ঘুষের রাজত্ব একদিন আমাদেরই কবর রচবে।
