অনলাইন ডেস্ক॥
হাজার প্রাণের বিনিময়ে ফ্যাসিবাদের পতন ঘটানো ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের প্রথম বর্ষপূর্তি আজ। নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ চালিয়েও ক্ষমতায় টিকতে না পেরে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে জুলাই অভ্যুত্থানের বিজয় অর্জিত হয়। তবে আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৫ বছরের কর্তৃত্ববাদী শাসনের পতন হলেও ছাত্র-জনতার মুক্তির আকাঙ্ক্ষা এখনও জাগ্রত। জুলাই শহীদদের স্বপ্নের বৈষম্যহীন দেশ গড়ার পথ এখনও অনেক বাকি।
দেশ আজ যখন অভ্যুত্থানের বিজয়ের বর্ষপূর্তি উদযাপন করবে, সে সময়ে শহীদ পরিবার খুঁজবে তাদের প্রিয় সন্তানকে। সরকারি গেজেট অনুযায়ী শহীদের সংখ্যা ৮৩৬ জন। জাতিসংঘের হিসাবে নিহত অন্তত এক হাজার ৪০০ জন। সরকারি হিসাবেই আহত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন ১১ হাজার আন্দোলনকারী।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান দিবস উপলক্ষে বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিন ও প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। জুলাই ন্যায় ও সাম্যভিত্তিক, বৈষম্য ও দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখিয়েছে বলে বাণীতে উল্লেখ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা।
এক বছর গেলেও, এখন জুলাই হত্যা ও হামলার কোনো মামলা নিষ্পত্তি হয়নি। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে একটি মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়েছে। ৪ আগস্ট জিগাতলায় আওয়ামী লীগের অস্ত্রধারীদের গুলিতে শহীদ আবদুল্লাহ সিদ্দিকের বাবা আবু সিদ্দিক সমকালকে বলেছেন, সবকিছুর আগে খুনিদের বিচার চাই।
পরপর তিনটি জাল-জালিয়াতির নির্বাচনের মাধ্যমে ভোটাধিকার হরণ, বাকস্বাধীনতা কেড়ে নিয়ে গুম-খুন, ভিন্নমতকে নিষ্ঠুরভাবে দমন, দুর্নীতি, ব্যাংক খাতে অনাচার, অর্থ পাচার, সর্বোপরি ক্ষমতার দম্ভে কার্যত একদলীয় শাসন কায়েম করেছিল ভোট ও ভাতের অধিকারের অঙ্গীকার করে ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসা শেখ হাসিনা। তার শাসনামলে অবকাঠামো উন্নয়ন হলেও, ক্ষমতার পরিবর্তনের গণতান্ত্রিক পথ বন্ধ করে দেওয়া হয়। সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিকে জেল-জুলুমের মাধ্যমে বারবার দমন করা হয়।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না থাকলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মুছে যাবে, জঙ্গিবাদের উত্থান হবে– এ বয়ান তৈরিতে ব্যবহৃত হয় সাহিত্য, সাংবাদিকতা, বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তাও। সরকারকে যে কোনো মূল্যে ক্ষমতায় রাখতে তৎপর পুলিশ, প্রশাসন হয়ে উঠেছিল নিপীড়নের হাতিয়ার। সরকারের মদদে অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ চলে গিয়েছিল গুটিকয়েক ব্যবসায়ীর হাতে।
এক পর্যায়ে শেখ হাসিনাকে স্বাভাবিক পন্থায় ক্ষমতা থেকে সরানো অসম্ভব বলে মনে করা হচ্ছিল। ডামি ভোটখ্যাত ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের পর বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ বিরোধী দলগুলো অনেকটা হাল ছেড়ে দেওয়ায়– এ ধারণা আরও পাকাপোক্ত হয়।
এর মধ্যেই ১ জুলাই ছোট্ট স্ফুলিঙ্গের মতো জ্বলে ওঠে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। হাইকোর্টের রায়ে সরকারি চাকরিতে কোটা পুনর্বহালের প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সূত্রপাত হয় এই আন্দোলনের। শুরুতে সামান্য ও নিরীহ আন্দোলনই ছিল। অতীতে রাজনৈতিক দল, শিক্ষার্থীদের আরও বড় ও ব্যাপক আন্দোলন দমনের অভিজ্ঞতা থাকায়, কোটা সংস্কারের দাবিকে গুরুত্ব দেয়নি সরকার।
তবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের লিয়াজোঁ কমিটির দায়িত্ব পালন করা এবং বর্তমানে এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক পদে থাকা নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী সমকালকে বলেছেন, আন্দোলন গোছানো ও পরিকল্পিত ছিল। শেখ হাসিনার পতন হতোই। ৫ আগস্টই হবে, ধারণা করতে পারিনি। ভেবেছিলাম আরও কয়েকদিন টিকবে।
মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, নাতি-নাতনিরা জনসংখ্যার এক শতাংশের কম হলেও, তাদের জন্য সরকারি চাকরিতে ৩০ শতাংশ কোটা রাখা হয়। একে তরুণ চাকরিপ্রত্যাশীরা বৈষম্যমূলক বললেও আওয়ামী লীগ তা মানতে চায়নি। এর বিরোধীদের স্বাধীনতাবিরোধী, রাজাকার, জঙ্গি আখ্যা দিয়ে দমনের পুরোনো পথ বেছে নেয়। তবে ক্ষোভের আগুনে জ্বলতে থাকা শিক্ষার্থীরা এবার রুখে দাঁড়ায়।
১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করে ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ। শিক্ষার্থীরা হার না মেনে রুখে দাঁড়ায়। ১৬ জুলাই রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ ‘বুকের ভেতর বইছে ঝড়, বুক পেতেছি গুলি কর’ স্লোগানে পুলিশের বন্দুকের সামনে প্রসারিত দুই হাতে সিনা টান করে দাঁড়ান। পুলিশ তাঁকে গুলি করে হত্যা করে। একই দিন পুলিশের গুলিতে চট্টগ্রামে আত্মাহুতি দেন ছাত্রদল নেতা ওয়াসিম আকরাম। ছাত্রলীগের হামলার বিরুদ্ধে প্রতিরোধে জীবন দেন ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতা ফয়সাল আহমেদ শান্ত।
ভয়ের সংস্কৃতিকে পরাস্ত করতে রাজপথে নামতে থাকে জনতা। ১৭ জুলাই শেখ হাসিনা জাতির উদ্দেশে ভাষণে সব হত্যার বিচার বিভাগীয় তদন্তের প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু তা আর গ্রহণ করেনি ছাত্র-জনতা। সেদিন রাতে প্রথমে রামপুরা, বাড্ডা এবং পরে যাত্রাবাড়ীতে লাখো মানুষ নেমে আসে সড়কে। সন্তানকে নিয়ে মা নামেন সড়কে। কিশোরী কন্যার হাত ধরে বাবা নামেন রাজপথে। নারী ও শিশুদের নজিরবিহীন অংশগ্রহণ দেখা যায় তাতে।
পরদিন রাজধানীর উত্তরা, মোহাম্মদপুর, মিরপুরে ছড়ায় বিক্ষোভের আগুন। ইন্টারনেট বন্ধ করা হয়। ওই দিন অন্তত ৭৭ জনকে হত্যা করা হয়। হেলিকপ্টার থেকে নিরস্ত্র আন্দোলনকারীদের ওপর গুলির অভিযোগও ওঠে ওই দিন। আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেছেন, এমন বর্বরতা স্বাধীন দেশে আর হয়নি।
১৯ জুলাই জুমার নামাজের পর শুধু রাজধানী নয়, সারাদেশের মানুষ নেমে আসে রাজপথে। তাদের দাবি একটাই– শেখ হাসিনাকে বিদায় নিতে হবে। ২১ জুলাই পর্যন্ত চার দিনে তিন শতাধিক ছাত্র-জনতাকে হত্যা করা হয়। নির্বিচার হত্যা ও গ্রেপ্তারে ২২ জুলাই থেকে ছাত্র-জনতা পিছু হটলেও ক্ষোভে আগুন আরও তীব্র হয়। শহর থেকে গ্রামেগঞ্জে ছড়ায় তা। ২৫ জুলাই ইন্টারনেট চালুর পর আগের হত্যা ও বর্বরতার ভিডিও-ছবি সামনে আসে। মানুষের ক্ষোভ আরও বাড়ে। ২৬ জুলাই ফেনী থেকে আবার আন্দোলন শুরু হয়। ছাত্র-জনতা গুছিয়ে উঠে রাজধানীর উত্তরা থেকে ২ আগস্ট ফের রাজপথে নামে। সেদিন কুমিল্লা, হবিগঞ্জ, নোয়াখালীসহ প্রায় সব জেলায় বিক্ষোভ হয় সর্বস্তরের জনতার। নারী, নানা ধর্মের মানুষ, সব পেশার মানুষ সরকারের পতনের দাবি তোলে।
পরদিন শহীদ মিনার থেকে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা করা হয় সরকার পতনের এক দফা। আওয়ামী লীগ আবারও দমনের পথ বেছে নেয়। ৪ আগস্ট ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে রক্তাক্ত দিন। রাজধানীসহ বিভিন্ন জেলায় অন্তত ১৫০ জনকে হত্যা করা হয়। জনতাও রুখে দাঁড়ায়। নরসিংদীতে জনতার ওপর গুলিবর্ষণ করা ছয় আওয়ামী লীগ নেতাকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। রংপুরে গুলি করতে এসে নিহত হয় আওয়ামী লীগ নেতা। সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুরে থানায় হামলা করে ১৫ পুলিশকে হত্যা করা হয়।
৪ আগস্ট রাতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ঘোষণা দেয়, পরদিনই হবে ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি। সেদিন রাতেই স্পষ্ট হয়ে যায়, জনতার মুখোমুখি হয়ে বিধ্বস্ত আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনা আর ক্ষমতায় থাকতে পারছেন না। তাঁর আত্মীয় এবং আওয়ামী লীগ নেতারা সেই রাতে দেশ ছাড়তে শুরু করেন।
৫ আগস্ট বেলা ১১টায় শহীদ মিনারে জমায়েত কর্মসূচি ছিল ছাত্র-জনতার। ভোর থেকেই শহীদ মিনারের দখল নেয় পুলিশ। সকাল সাড়ে ১০টা থেকে নির্বিচার গুলি শুরু করে। সেদিন অন্তত ২৩ জন নিহত হয় চানখাঁর পুল ও শহীদ মিনার এলাকায়। ততক্ষণে যাত্রবাড়ী, উত্তরা, মোহাম্মদপুরে লাখ লাখ মানুষ জমায়েত হয়েছে। তাদের লক্ষ্য গণভবন থেকে শেখ হাসিনাকে উৎখাত করে বিচারের মুখোমুখি করা। দুপুর দেড়টার দিকে খবর আসে, শেখ হাসিনা আর ক্ষমতায় থাকছেন না। সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরাও দাঁড়ান জনতার পাশে।
উল্লসিত জনতা গণভবনের দিকে এগোতে থাকে। যাত্রাবাড়ীসহ দেশের বিভিন্ন থানা ঘেরাও করা জনতাকে সেই সময়েও নির্বিচার গুলি করে পুলিশ। জনতা বাধা পেরিয়ে ৩টার দিকে গণভবন পৌঁছায়। তবে ২টা ৩৫ মিনিটে হেলিকপ্টারে ভারতে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা।
আন্দোলকারী, শহীদ পরিবার, আহতদের অনেকেই গত এক বছরে বলেছেন, শেখ হাসিনাকে হটানোর লক্ষ্য পূরণ হলেও মুক্তির আকাঙ্ক্ষা এখনও অপূর্ণ। ঊনসত্তর, একাত্তর, নব্বইসহ বারবার জনতা রক্ত দিলেও প্রকৃত লক্ষ্য হাসিল হয়নি। গণতন্ত্র স্থায়ী হয়নি। চব্বিশের রক্ত যেন বৃথা না যায়, এই আশা তাদের।
